টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তার মাদকাসক্তির খবর কারোরই অজানা নয়। অভিনেতা নিজেই অবশ্য তার অন্ধকার জীবনের কথা অকপটে সবাইকে জানিয়েছেন। এর আগে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তার মাদকাসক্তির কথা তুলে ধরেছিলেন সকলের সামনে। তবে এখন তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। জীবনের একটা সময় মাদকের প্রতি আসক্তি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সম্প্রতি ফেসবুকে তার সেই পোস্ট করা স্বীকারোক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। অনিন্দ্যর নতুন করে জীবনকে ফিরে পাওয়ার গল্প মন ছুঁয়ে গিয়েছে অনেকেরই।
ফেসবুকে অনিন্দ্য লিখেছেন, “২২শে জানুয়ারি, ২০০৮। কালকে আমার জন্মদিন। কালকে আমার নেশামুক্তির ১৪ বছর। ২৯শে ডিসেম্বর তো বায়োলজিক্যাল বার্থডে। কিন্ত কালকের দিনটা আমার কাছে আরো স্পেশাল। এই দিনটা আজও আমার কাছে জলের মতো স্পষ্ট। চোখ বুঝলেই এই দিনটা দেখতে পাই বলেই হয়তো আজকে লিখছি।” তিনি আরও লিখেছেন, “ব্যাঙ্কসাল কোর্টে হাজিরা দিয়ে আমাকে রিহ্যাবে ফিরতেই হতো। ৯টার বনগাঁ লোকাল আর সাথে ছিল শেষবারের মতন নেশা করবো বলে একটু ব্রাউন সুগার, পাতি বাংলায় কয়েকটা পাতা আর একটা সিরিঞ্জ, একটু তুলো।
হাবড়া স্টেশনে নেমে একটু এগোলেই সেই রিহ্যাব যেখান থেকে আমার ভালো থাকার লড়াই শুরু হয়েছিল। তার আগে প্রায় ২৮ বা ২৯ টা ডিটক্স আর রিহ্যাব হয়ে গেছে যেদিন ছাড়া পেতাম সেদিনকেই রিলাপস, এরম একটা প্যাটার্ন ছিল। ৬/৭ বছর ধরে অনবরত ঘুরতে থাকা একটা বৃত্ত। নয় বাইরে নেশা করছি নয় তালা চাবির ভিতরে ভালো আছি। তালা চাবির বাইরে বেরোলেই আবার নেশা।
না নিজে বিশ্বাস করতাম যে আমি কোনোদিন ভালো হতে পারবো, না আমাকে কেউ বিশ্বাস করতো যে আমি কোনোদিন নেশা ছেড়ে দেবো। উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের আর কতই বা ক্ষমতা? মায়ের সোনার গয়না থেকে শুরু করে বাবার সঞ্চয় বাড়ির সব কিছুই মোটামুটি ততদিনে প্রায় শেষ। লোহা, অ্যালুমিনিয়াম,কাঁসার জিনিস তখন আমার কাছে সোনার মতনই দামী। যে কোনো গাড়ির লক খুলতে লাগতো ঠিক তিন মিনিট। একটা নোকিয়ার মোবাইল মানে ক্যাশ ২/৩ হাজার। সেটাই অনেক তখন আমার কাছে।
এরম একটা সময় আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে যদি চলতে থাকে আমি নিজেকে ২৮ বছর অবধিও টানতে পারবো না আর চোখের সামনে চারটে ইউজিং পার্টনারকে পরপর মরতে দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলাম। এতটাই বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলাম যে আমার সেই রিহ্যাবে যাওয়া আর সেখানে আবার কয়েকমাস চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আরো কয়েকদিন টানতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আর এই উপলব্ধিটাই আমাকে একটু হলেও সাহস যুগিয়ে ছিল। এভাবেই আমার ভালো থাকার শুরু।
শুরুটা সত্যি কঠিন ছিল। না কেউ বিশ্বাস করতো, না নিজে বিশ্বাস করতাম যে নেশা করা ছেড়ে দেবো। জীবনের ধ্যানজ্ঞান ভালোবাসা ওই নেশাই ছিল। ওটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নেশা আমাকে মারতে চেয়েছিল। আজকে যখন রাস্তায় লোকে সেলফি তুলতে চায়, অটোগ্রাফ চায়, ভালোবাসা দেয় তখন আমি নিজেকে দেখি আর পুরোটাই কেমন স্বপ্নের মতন লাগে। এটা সত্যি তো? কোথায় সেই ছেলেটা আর কোথায় আজকের আমি। হয়তো আরো কিছু করতে পারতাম। হয়তো আরও একটু জীবনটা গোছাতে পারতাম, পারিনি কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই। যা আছে, যে টুকু সম্মান আর ভালোবাসা আমাকে সমাজ ফিরিয়ে দিয়েছে আমি সেটা নিয়েই খুশি।
বাকিরা এগোক না, ক্ষতি কি আমার শুরু তো অনেক নিচ থেকে আর আমার লড়াইটাও একটু হলেও আলাদা, একটু হলেও কঠিন। আমার লড়াই সেই বাঁদরটার সাথে যে আজকেও আমার মধ্যে আছে। যাকে আমাকে প্রতিনিয়ত বশে রাখতে হয়। তার জন্যে যদি দামী গাড়ি বাড়ি একটু দেরি হয়, হবে। নাহলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। মা চলে যাওয়ার আগে আমার নেশামুক্ত দেখে গেছে কিন্ত বাবা চলে যাওয়ার আগে আমার ঘুরে দাড়ানো প্রত্যক্ষ করে গেছে। গর্ব করে সবাইকে বলতো আমি অনিন্দ্যর বাবা। আজ বোনেরও গর্ব আমি। আর কি চাই?